আজ মহান বিজয় দিবস :: বিজয়ের ৪১ বছর


“সব কটা জানালা খুলে দাওনা

আমি গাইব, গাইব বিজয়ের-ই গান………..”

আজ ১৬ ডিসেম্বর ২০১২। স্বাধীনতার ৪১ বছর। ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, আর আমরা পেয়েছিলাম দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পুরুস্কার স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের মার্চের ২৫ তারিখ কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী আমাদের দেশের নিরস্র-অসহায় মানুষদের উপর রাতের অন্ধকারে কা-পুরুষের মত বর্বর আক্রমণ চালায়। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ বেঁচে থাকার যুদ্ধ, এ যুদ্ধ স্বাধিকারের যুদ্ধ, এ যুদ্ধ মায়ের ভাষার যুদ্ধ, এ যুদ্ধ অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ, এ যুদ্ধ হয়েছিল বিশ্বের কাছে নিজেদেরকে আপন পরিচয়ে পরিচিত করার গৌরবময় যুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (আজকের শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর প্রায় ৯০,০০০ সদস্য বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর (বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী) কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে।ঢাকার কেন্দ্রস্থলে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার উপস্থিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না। আত্মসমর্পণ দলিলের ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ:

The Pakistan eastern command agree to surrender all Pakistan armed forces in Bangladesh to Lieutenant General Jagjit Singh Aurora General, officer-commanding in chief of the Indian and Bangladesh forces in the eastern theatre, This surrender includes all Pakistan land, air and naval forces and civil armed forces. They are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieutenant General Jagjit singh. The Pakistan eastern command shall come under orders of Lieutenant-General Jagjit Singh Aurora as soon as this instrument has been signed, Disobedience of orders will be regarded as breach of the surrender terms and will be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora will be final, should any doubt arise as to the meaning or interpretation of surrender terms. Lieutenant General Jagjit Singh Aurora gives a solemn assurance that personnels who surrender shall be treated with dignity and respect that soldiers are entitled to in accordance with provisions of the Geneva Convention and guarantees the safety and well-being of all Pakistan military and para-military forces who surrenders, protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorities and personnels of West Pakistan origin by the forces under the command of Lieutenant General Jagjit singh Aurora. (সূত্র: উইকিপিডিয়া) এভাবেই এসেছিল আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়।

কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন সব সময়ই চষে বেড়ায় তা হল, “ এ দীর্য ৪১ বছরেও কি দেশ প্রকৃত বিজয় অর্জন করতে পেরেছে ?” এর উত্তর সর্বদাই চলে আসে “না”। আমরা চেয়েছিলাম নির্দিষ্ট একটা স্বাতন্ত্র্য ভূখণ্ড – তা পেয়েছি।

আমরা চেয়েছিলাম একটা স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা – পাইনি।

আমরা চেয়েছিলাম শোষনমুক্ত একটা সমাজ – তা পাইনি।

আমরা চেয়েছিলাম সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিশ্চয়তা – আজও পাইনি

আমরা চেয়েছিলাম স্বাভাবিক জন্ম ও মৃত্যুর নিশ্চয়তা – পাইনি (ওটা দেশের রাজনীতিবিদদের দয়ার উপর নির্ভরশীল)।

এভাবে হাজারো চাওয়ার সমন্বয়ে সেদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। তাজা প্রাণ গুলো অকাতরে বিলীন করে দিয়েছিলেন দেশের সূর্য সন্তানেরা। কিন্তু আজও তার সুফল আমরা পাইনি। আদৌ পাব কিনা মনে হয়না।

আজও দেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, রাজনীতি করছে, ব্যবসা করছে আবার শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পতাকা তাদের গাড়ীতে পৎ পৎ করে উড়ানোর সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। আজও তাদের বিচারের বিপক্ষে বেজন্মা ও জারস সন্তানেরা এ দেশে বিরাজ করছে। তাদের পক্ষে হরতাল হচ্ছে। টকশোর নামে নব্য রাজাকারগুলো ওদের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলছে। আদালতে ওদের পক্ষে বেজন্মা, নির্লজ্জ কাপুরুষরা মামলা পরিচালনা করছে। ভাবতে খুব কষ্ট হয়। ঘৃণায় মুখ ভরে থু থু চলে আসে।

এ প্রসঙ্গে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিএনপির রাজাকারদের বাঁচানোর এক হরতালের কথা মনে পড়ল। ঐ হরতালকে নিয়ে এক প্রবন্ধে জনৈক লেখক মুহম্মদ শফিকুর রহমান দৈনিক জনকণ্ঠে (২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১)তাঁর “৪০ বছর পর পরাজিত ঘাতক বাহিনী প্রকাশ্য মহড়া দিল” শিরনামের লেখায় এক প্যারায় লিখেছিলেন

“স্বাধীনতার ৪০ বছর হয়ে গেল। ওই হায়েনাদের চরিত্র কি এতটুকু পাল্টেছে? না, পাল্টায় নি। তাই দেরিতে হলেও আজ তাদের আদালতের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে কেবল স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট তথা মুক্তিযুদ্ধের পৰের সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী আছেন বলেই। খালেদা জিয়া তো যুদ্ধাপরাধী, বিশেষ করে আলবদর-আলশামসের দুই শীর্ষ ঘাতক নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা উড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা তথা মুক্তিযুদ্ধের পৰের গোটা জাতিকেই অপমান করেছেন। তার কাছ থেকে কেউ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আশা করে না। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। হরতাল পর্যন্ত দিয়ে দিলেন। বাজারে একটা কথা শোনা যাচ্ছে যে, বিএনপির নেতাদের অনেকই এই হরতাল না দেয়ার পৰে ছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া কারও কথা শোনেননি। মনে হয়, তিনি জামায়াতের মধ্যে এমনভাবে মিশে গেছেন যে, বিএনপিতে তার আর বিশ্বাস নেই।

হ্যাঁ তা ছাড়া তিনি গত বছরের ২০ নভেম্বর চাপাইনবাব গঞ্জের জনসভায় বলেছিলেন

“সরকার স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী ও সাকা চৌধুরীকে আটক করেছে। তারা স্বাধীনতাবিরোধী নন। যারা দেশ বিরোধী বিভিন্ন চুক্তি করছে তারাই স্বাধীনতাবিরোধী। অবিলম্বে নেতাদের মুক্তি দিতে হবে”। [সমকাল ২০.১১.২০১১]

এভাবে হাজারো প্রমাণ আছে যার দ্বারা প্রমাণিত আজকের প্রধান বিরোধীদল (বিএনপি) ঐ যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই হল আমাদের বিজয় !!! আজ স্বাধীন দেশেও ঐ নরপশু ও হায়েনাদের দোসরদের কাছে আমরা জিম্মি, নিরুপায়।

এমন বিজয় কি আমরা চেয়েছিলাম ? আজও বিশ্বের কোন দেশে আমরা আমাদের পরিচয় নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারিনা। আজও ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দাড়ে দাড়ে ঘুরে ফিরি।আসেনি অর্থনীতির স্বয়ংসম্পূর্ণতা। আসেনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও স্বয়ংসম্পূর্নতা। স্বাধীন দেশ হবার পরও দেশের রাজনীতি ও ক্ষমতা নির্ভর করে অদৃশ্য শক্তির অঙ্গুলি হেলনের উপর। বস্তুত ঐ শক্তিই আমাদের দেশের স্বাধীনতা চায়নি।

আমাদের বিপক্ষে, আমাদের হত্যার জন্য, নিশ্চিন্হ করার জন্য ১৯৭১-এ সপ্তম নৌ-বহর পাঠিয়েছিল। কিন্তু আমরা কি দেখি ? আমাদের স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক নেতারা একটু হলেই ওদের কাছে ছুটে যায় নালিশ জানাতে। যেন পিতার কাছে সন্তানের আকুতি ! ধিক তোদের!! তোদের উচিত গলায় কলশি বেঁধে পচা ডোবায় ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করা, দেশকে কলঙ্কের হাত হতে মুক্তি দেয়া। তোদের মত রাজনীতিবিদ ও দল এদেশের আপমর জনতারা চায়না, চাইতে পারেনা।

আমরা ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে হারিয়েছিলাম অনেক কৃতি সন্তান তথা বুদ্ধিজীবীদের। তাঁরা চলে গিয়ে মনে হয় ভালোই করেছেন। কারণ তাঁরা বেঁচে থাকলে আজকের বুদ্ধিজীবীদের দেখলে লজ্জায় মুখ লুকানো ছাড়া উপায় থাকত না। স্বাধীন হবার কারণে আমরা পেয়েছি এই সকল গণ্ডমূর্খ টাইপের রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধী তথা বিদেশী প্রভুদের পা-চাটা কুকুর টাইপের একপাল বুদ্ধিজীবী। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার বদৌলতে রাতের বেলা মোটা অংকের বিনিময়ে টিভি পর্দায় ঐ সব দুই পা ওয়ালা জন্তু গুলোর আবির্ভাব হয়। মিথ্যার ও চাপাবাজীর এক অনন্য অনুষ্ঠানে রুপ নিয়েছে আজকের ঐ সকল তথাকথিত টক শো। যার প্রকৃত নাম হওয়া উচিত “ঠক” শো। ধিক !! দেশের বিজয় কি এ জন্যেই হয়েছিল ?

আমরা চেয়েছিলাম স্বাধীন  মিডিয়া জগত। সংবাদ, চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক সব কিছুতেই স্বতন্ত্রতা। কিন্তু হয়েছে কি ? হয়নাই। সংবাদ মিডিয়া গুলো হল ব্যবসা নির্ভর। সব মিডিয়ার মালিক হল বড় বড় ব্যবসায়ী। ওদের অপকর্মের শেল্টার দেয়ার জন্যেই ঐ সকল মাধ্যম। মাঝে মাঝে দেখা যায়, এক ব্যবসায়ীর পত্রিকা অন্য ব্যবসায়ীর নাড়িভুঁড়ি নিয়ে রীতিমত ল্যাবে গবেষণার লিপ্ত হয়। হাসিও পায় আবার দুঃখও হয়। এই কি স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম তথা মিডিয়া ? বাংলাদেশের বর্তমান সাংবাদিক না যেন ভয়ানক সন্ত্রাসী। ওদের সন্ত্রাসকে ঘাতক ব্যাধি এইডস-এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ওরা ধরলে আর রক্ষা নেই। যাকে বলে স্লো-পয়জন। মৃত্যু বা পরাজয় অনিবার্য। ওরা পারেনা বা করেনা এমন অপরাধ সমাজে আছে বলে আমার জানা নাই। আবার পত্রিকার সুবাধে ওরাই সবচেয়ে সাধু ও বিবেকবান !!! তাই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় মিডিয়া হলে সাতখুন মাফ !!!

দেশের প্রতিটি স্তরে আজ দুর্নীতি অক্টোপাসের মত ছেয়ে গেছে। এর থেকে জাতীর মুক্তি মনে হয়না হবে কোন দিনই। কারন এ দুর্নীতি শুধু উপড় তলাতেই নয়, সর্বস্তরে। যাকে এক কথায় বলা যায় “টপ টু বটম”। এটাই হলো আমাদের বিজয়ের অর্জন ! বিদেশের মাটিতে মাথা উচু করে নিজের পরিচয় দেয়া যায়না। এর কারন গুলোর মধ্যে প্রধান হলো দেশের ও যারা প্রবাসে আছে তাদের দুর্নীতি ও অসুস্থ্য রাজনীতি। যারা প্রবাসে বিভিন্ন কাজের উদ্যেশ্যে আজ অবস্থান করছে তারা জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন অনৈতিক ও অবৈধ কাজের সাথে। তাই বিদেশে আমাদের পরিচয় “বাঙাল” ও নাম্বার ওয়ান “চিটার”। এই হলো আমাদের বিজয়ের অর্জন !

এভাবে লিখলে হয়ত এর শেষ হবে না। হাজার হাজার পাতা ভরে যাবে। এর জন্যেই কি আমাদের বিজয় এসেছিল ? এর জন্যেই কি ৩০ লক্ষ শহীদেরা তাঁদের তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন ? কি এর উত্তর ? আমার জানা নাই। শুধু এক কথায় বলতে পারি বিজয় এখনও আসেনি, বিজয় এখনও হয়নি।

কবি ফররুখ আহম্মদেরর সেই পাঞ্জেরী কাবিতার প্রথম ও শেষ কয়টি লাইন দিয়ে শেষ করছি:

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?

এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?

সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?

তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;

অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।

………………………. ………………..।

পাঞ্জেরী! জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,

জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!

দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!

//

Leave a comment

Filed under মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি

আপনার মতামত দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.